মোহাম্মদ শাহ্ কামালঃ
মেঘ, বৃষ্টি এবং কুয়াশার আড়ালেই হাত বাড়ালেই যেন শ্বেত-শুভ্র হিমালয়! আর একটু এগুলেই হয়তো ছুঁয়ে ফেলা যাবে চোখ জুড়ানো, মন ভুলানো বরফে ঢাকা পর্বতটাকে। হিমালয় মানেই এক বিস্ময়কর রহস্য, সৌন্দর্যের সব রং এর মিশ্রণেই অপরূপ কাঞ্চনজঙ্ঘা।
স্বাধীন ভূখণ্ডের পরে কাঁটাতার পেরিয়ে যাদের পর্বতটাকে দেখার সৌভাগ্য হয় না তাদের জন্যে সুবর্ণ সুযোগ শরতের শীতকালে স্পষ্ট ফুটে উঠে রূপালি কাঞ্চনজঙ্ঘা। পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় এসে প্রকৃতি পিপাসু সমতল ভূমির যেকোনো মানুষ উপভোগ করতে পারেন কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপালি লাবণ্য।
’৭১ এর মুক্তাঞ্চল স্বাধীনতার তীর্থ ভূমি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া থেকেই বিশ্বের ৩য় অবস্থানে থাকা হিমালয় পর্বতমালা কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বত শৃঙ্গ দর্শন করতে ইতোমধ্যে পর্যটকরা আসতে শুরু করেছে। তেঁতুলিয়ার বুক চিরে প্রবাহিত মহানন্দা বিভক্ত করেছে দু’দেশের ভূখণ্ডকে। প্রাকৃতিক পরিবেশের লীলাভূমি, সমতল ভূমির চায়ের রাজ্যের তেঁতুলিয়ায় দাঁড়িয়ে সোজা উত্তরে তাকালে চোখে পড়বে সুনীল আকাশ আর হিমালয় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি। হিমালয় পর্বতমালা থেকে ১৬৫ কিলোমিটার দূরে তেঁতুলিয়া উপজেলা থেকেই দেখা যাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘার প্রধান শৃঙ্গ।
শরৎ ও হেমন্তের মেঘমুক্ত আকাশে প্রায় প্রতিদিনই হিমালয় দেখার সুযোগ ঘটে পর্যটকদের। শরতের শেষের দিক থেকে শীত পর্যন্ত সবচেয়ে আকর্ষণীয় দৃশ্য দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা আর হিমালয়ে। মনোরম আবহে প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্য ভ্রমণ পিপাসুদের মনে অপার্থিব মায়ার ঘোর সৃষ্টি করে। তেঁতুলিয়া ঘেঁষে বয়ে যাওয়া মহানন্দা নদীর পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালে দেখা যায় সূর্যের বর্ণিল আলোকচ্ছটায় উদ্ভাসিত এভারেস্ট শৃঙ্গ।
তাই ভোর বেলা থেকে বিকেল পর্যন্ত ডাকবাংলো এবং বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত ঘেঁষে চলা মহানন্দা নদীর তীরে বসে প্রকৃতি প্রেমীদের আড্ডা। সন্ধ্যা নামার আগে ভিন্ন রূপের মহানন্দা হৃদয় কাড়ে পর্যটকদের। বাংলার বুক চিরে যে সূর্য উঠে ভোরে, সন্ধ্যায় আবার সেই সূর্য ডুব দেয় প্রতিবেশী দেশের হিমালয়ের কাঞ্চনজঙ্ঘার আড়ালে।
শরৎ, হেমন্ত আর শীত কালেই দেখা মেলে শ্বেতশুভ্র এই মহানায়কের। ভোরের আলো মেখে জাগতে শুরু করে। তারপর ক্ষণে ক্ষণে রং পাল্টাতে থাকে। অপার সৌন্দর্য্যের বিস্তৃতি ঘটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মনে হয় হাসছে পাহাড়। তার শরীর ঘেঁষে চলে গেছে বিস্তৃত হিমালয়। সবুজ আর কালো রং মেখে হিমালয়ও হয়ে ওঠে অপরূপ।
নানা রং নিয়ে খেলা করে কাঞ্চনজঙ্ঘা। জেগে ওঠার শুরুতে টকটকে লাল। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কমলা, তারপর হলুদ, তারপর সাদা। মাঝে মাঝে হঠাৎ হারিয়ে যায় মেঘের আচলে। মেঘ সরে গেলে আবার উঁকি দেয়। লুকোচুরির খেলা চলে সারাদিন।
কাঞ্চনজঙ্ঘা পৃথিবীর তৃতীয় এবং হিমালয় পর্বতমালায় ২য় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ। এর উচ্চতা প্রায় ২৮ হাজার ১৬৯ ফুট বা ৮ হাজার ৫৮৬ মিটার। এটি ভারতের সিকিম রাজ্যের সঙ্গে নেপালের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তে অবস্থিত। কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে চারটি নদীর উৎপত্তি ঘটেছে নদীগুলি বাংলাদেশেও প্রবাহিত হয়।
কাঞ্চনজঙ্ঘা নিয়ে রয়েছে নানা রকমের লোককাহিনী। এর আশপাশের অঞ্চলটিকে বলা হয় পর্বত দেবতার বাসস্থান। দেবতার নাম কাঞ্চনজঙ্ঘা ডেমন। এটি এক প্রকার রাক্ষস। অনেকে বিশ্বাস করে অমরত্বের রহস্য লুকানো আছে এই শ্বেতশুভ্র শৃঙ্গের নিচে।
তবে সবসময় দেখা মেলে না সাদা শুভ্র এই পাহাড়ের। মেঘ আর কুয়াশা মাঝে মাঝেই আড়াল করে রাখে তাকে। তখন অপেক্ষা ছাড়া কোনও উপায় থাকে না। এ জন্য অনেকে বলে থাকেন কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার জন্য কপালও লাগে। পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলাসহ জেলার যে কোনও প্রান্ত থেকে দেখা যাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা।
কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্য দেখতে বর্তমানে আসতে শুরু করেছে পর্যটকরা। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসতে শুরু করে তারা। পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন জেলা প্রশাসন।
পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম জানান, ট্যুরিস্টদের আনন্দকে আমরাও উপভোগ করছি। তাই তাদের নিরাপত্তা, থাকা খাওয়ার বিষয়গুলোকে উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে মনিটরিং করা হচ্ছে। এ ছাড়া তেঁতুলিয়া ডাকবাংলোসহ পর্যটন স্থানগুলোকে দৃষ্টি নন্দন করে গড়ে তোলা হচ্ছে। এই আয়োজন চলমান আছে।
পুলিশ সুপার এস এম সিরাজুল হুদা বলেন, তেঁতুলিয়া ট্যুরিস্ট পুলিশের মাধ্যমে পর্যটকদের নানাভাবে সহায়তা করা হচ্ছে, দেশের আর সব জায়গার চেয়ে পঞ্চগড়ের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা অনেক ভালো। বিগত ৫০ বছরেও এখানে প্রকাশ্যে কোনও সহিংসতা ঘটেনি।
পঞ্চগড়ের শিক্ষাবিদ মো. সফিকুল ইসলাম বলেন, প্রকৃতি তার সব কিছু যেন উজাড় করে দিয়েছে হিমালয় কন্যা পঞ্চগড়কে। প্রকৃতির বিলাসী বাহার, নদীর সুর ধ্বনি, নীল আকাশের সঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘার যে সখ্যতা তা হৃদয়ে ধারণ করার মতো। তাইতো হিমালয় আর নীল আকাশের মায়াবী মিলন দেখার জন্যে প্রতিবছর তেঁতুলিয়ায় ছুটে আসে অসংখ্য পর্যটক। এ জেলার সংস্কৃতি ইতিহাস এবং ঐতিহ্য মানুষের হৃদয়কে সমৃদ্ধ করে।
তেঁতুলিয়া উপজেলা সদরের সাবেক ইউনিয়ন চেয়ারম্যান কাজী আনিসুর রহমান বলেন, আমরা এই জেলার ঐতিহ্য ধরে রাখতে চাই। ট্যুরিস্টদের সার্বক্ষণিক সহায়তা করা হচ্ছে, যেন তারা অনায়াসে সমতলের চা, মাল্টা, উচ্চ-ফলনশীল আম এবং বিদেশি টিউলিপ বাগানসহ তেঁতুলিয়ার প্রেম প্রকৃতি উপভোগ করতে পারে।
পঞ্চগড় হিমালয় পর্বতমালার সমতল অঞ্চল। তেঁতুলিয়া থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দূরত্ব ৮০ কিলোমিটার। তাই এই জেলাকে বলা হয় হিমালয়ের কন্যা। তেঁতুলিয়ার বুক চিরে প্রবাহিত মহানন্দা বিভক্ত করেছে ভারত এবং বাংলাদেশকে। প্রাকৃতিক পরিবেশের লীলাভূমি সমতল ভূমির এই চায়ের রাজ্যের তেঁতুলিয়ায় দাঁড়িয়ে সোজা উত্তরে তাকালে চোখে পড়বে সুনীল আকাশ আর হিমালয় এখানে দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি। হিমালয় পর্বতমালা থেকে ১৬৫ কিলোমিটার দূরে তেঁতুলিয়া উপজেলা থেকেই দেখা যাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘার প্রধান শৃঙ্গ।
তেঁতুলিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা সোহাগ চন্দ্র শাহা বলেন, স্বাধীনতার এই তীর্থভূমি তেঁতুলিয়ার পাশে অবস্থিত হিমালয় পর্বত মালার। ভৌগলিক কারণে এখানকার মানুষগুলো পাহাড়সম হৃদয়ের অধিকারী।