ব্যুরো প্রধানঃ- নিরেন দাসঃ
ছোটবেলা থেকেই সবাই শুনে এসেছি এবং পড়ছি শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। শুধু পড়াশুনা নয় এটিই বাস্তবতা যে শিক্ষা ছাড়া মানুষ ও জাতি সবই অচল। শিক্ষার প্রাথমিক এবং মৌলিক ধাপ হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা যেখান থেকে মানুষের শিক্ষা জীবন শুরু। আর এই শুরুর ক্ষেত্রে যদি ভিত শক্ত না হয় তাহলে ব্যক্তি তথা রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় অন্ধকার নেমে আসবে এটিই স্বাভাবিক এবং চিরন্তন। কিন্তু আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় আমরা কী দেখছি? সম্প্রতি প্রাথমিক স্তরে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকারের বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরও সে হারে শিক্ষার্থী বাড়ছে না বরং দিনদিন কমে আসছে। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলার প্রারম্ভে এর চ্যালেঞ্জগুলো আগে তুলে আনা প্রয়োজন।
মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণের চ্যালেঞ্জ/ সমস্যাসমূহ নিম্নরূপঃ
১। মেধাবী ও কর্তব্যপরায়ণ শিক্ষকের অভাবঃ মেধাবী ও কর্তব্যপরায়ণ শিক্ষক ছাড়া মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। শিক্ষার ভিত্তি মজবুত করতে না পাড়লে বুদ্ধিবৃত্তিক জাতি গঠন করা সম্ভব না। তাই সর্বাগ্রে নজর দিতে হবে শিক্ষক বাছাইয়ের দিকে।
২। একই বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত থাকাঃ অন্যান্য পেশায় ৩ বছর অন্তর অন্তর বদলির নিয়ম থাকলেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এধরণের নিয়ম নাই। ফলে শিক্ষকদের মধ্যে একগুয়েমিতা পরিলক্ষিত হয়। তাই অন্তত ৩ বছর অন্তর অন্তর বদলির ব্যবস্থা থাকা বাঞ্চণীয়।
৩। চাহিদাভিত্তিক সাব-ক্লাস্টার প্রশিক্ষণ বন্ধ থাকাঃ সাব-ক্লাস্টার প্রশিক্ষণ হচ্ছে একধরণের সঞ্জীবনী প্রশিক্ষণ। এ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদের একগুঁইয়েমিতা দূর হয়, বিগত দিনের ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধনের সুযোগ পায়।
৪। প্রধান শিক্ষক- সহকারী শিক্ষকের মধ্যে চেইন অব কমান্ড নিশ্চিত করতে না পারাঃ কিছু কিছু বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক- সহকারী শিক্ষকের মধ্যে অন্তর্দ্ধন্দ্ব মানসম্মত শিক্ষার অন্তরায়।
৫। কারিকুলাম সম্পর্কে শিক্ষকের জ্ঞানের অপ্রতুলতাঃ কারিকুলাম সম্পর্কে অস্পষ্টতা থাকলে কারিকুলাম ডেসিমিনেশন সম্ভব হবে না। এজন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণে কারিকুলামের ধারণা স্পষ্টিকরণের পাশাপাশি শিক্ষকদের কর্তব্যপরায়ন হতে মটিভেট করতে হবে।
৬। শিক্ষকদের প্রশ্নপত্র প্রণয়নে অদক্ষতাঃ শিক্ষকগণ পাঠদান করেন ঠিকই কিন্তু প্রশ্নপত্র প্রণয়নে সরাসরি জড়িত না থাকায় প্রশ্নপত্রের কাঠামো সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা থাকেনা। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন একদিকে যেমন শিক্ষকের প্রশ্নের কাঠামো জানতে সাহায্য করে অপরদিকে তেমনি তারা বিষয় জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়।
৭। শিক্ষকদের পাঠ্যাভ্যাসে অনীহাঃ পাঠদান বহির্ভূত কাজে শিক্ষকদের সম্পৃক্ত করায় শিক্ষকদের পাঠ্যাভ্যাসের প্রতি আগ্রহ হারায়।।
৮। আইসিটিতে দক্ষ শিক্ষকের অপ্রতুলতাঃ সরকারের গৃহীত ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের অংশ হিসেবে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে ডিজিটালাইজেশনের আওতায় আনার জন্য দেশের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়াসহ প্রয়োজনীয় আইসিটি পণ্য সরবরাহ করা হয়েছে। কিন্তু আইসিটিতে দক্ষ শিক্ষকের অপ্রতুলতায় পণ্যগুলো যথাযথ ব্যবহার করা হচ্ছে না।
৯। শিক্ষকস্বল্পতাঃ বিদ্যালয়গুলোতে ১ম থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিদিন ২৪টি বিষয়সহ সংগীত, চারুকারু, শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে পাঠদান করা হয়। অপরদিকে সকাল ৯.০০/৯.৩০ টা হতে ১১.৩০ পর্যন্ত প্রাক-প্রাথমিকের পাঠ পরিচালনা করতে হয়। সকাল ৯.০০টা হতে ৩.৩০/৪.১৫ টা পর্যন্ত একজন শিক্ষককে গড়ে ৬ থেকে ৭ টি বিষয়ে পাঠদান করতে হয়। এই দীর্ঘ সময়ে একজন শিক্ষকের পক্ষে সকল বিষয়ে মানসম্মত পাঠদান করা দুরুহ বলে মনে করি। এমতাবস্থায় প্রতিটি বিদ্যালয়ে কমপক্ষে ৭ জন শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করে বিদ্যালয়গুলোকে এক শিফটে পরিনত করলে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত হবে এতে কোন সন্দেহ নাই।
১০। পাঠ পরিকল্পনাভিত্তিক পাঠদান পরিচালনা না করাঃ শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য পরিকল্পিত পাঠদানের বিকল্প নাই। কিন্তু বিদ্যালয়গুলোতে পাঠ পরিকল্পনা মোতাবেক পাঠদানের হার খুবই কম।
১১। অনিয়মিত উপস্থিতিঃ শিক্ষার্থীদের অনিয়মিত উপস্থিতি মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার প্রধান অন্তরায়। বিশেষ করে কোভিড-১৯ পরবর্তী আনুষ্ঠানিক পাঠদান শুরু হলেও শিক্ষার্থীদের অনিয়মিত উপস্থিতি শিখনঘাটতি পূরণে শিক্ষকদের যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে। এমতাবস্থায় শিক্ষকদের নিয়মিত হোমভিজিটের উপর জোর দেওয়া একান্ত জরুরি।
১২। অভিভাবকদের অসচেতনতাঃ তৃণমূল পর্যায়ে অভিভাবকদের অসচেতনতা মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা অন্যতম বাধা। অভিভাবকগণ শিক্ষার গুরুত্ব না বুঝলেও দারিদ্রতার কারণে আর্থিক গুরুত্বটা বেশ ভালো বুঝেন। তাই তারা তাদের সন্তানদের বিভিন্ন কায়িক শ্রমে নিয়োজিত করেন।
১৩। অভিভাবকদের কেজি স্কুল প্রীতিঃ প্রাথমিক শিক্ষার শিক্ষক্রম অনেক গবেষণার ফল। যে বয়সে যতটুকু শিক্ষার প্রয়োজন সে বয়সে ততটুকু শিক্ষা নিশ্চিত করা বাঞ্চণীয়। কিন্তু তথা কথিত সচেতন কিংবা বিত্তবান অভিভাবকরা কেজি স্কুলের মাধ্যমে সন্তানদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে বইয়ের পাহাড়। ফলে শিক্ষার্থীরা সৃজণশীল চিন্তার চেয়ে মুখস্থ নির্ভর হয়ে পড়ছে।
১৪। অভিভাবকদের প্রাইভেট, হোম টিউটর প্রতি আগ্রহ থাকা: বিদ্যালয়ে পাঠদান হয় না। অভিভাবকদের এই ধারণার কারনে প্রাইভেট, হোম টিউটর এ প্রতি প্রবল আগ্রহ থাকা।
১৫। শ্রেণিকক্ষের অপ্রতুলতাঃ পাঠদান আর শ্রেণিকক্ষ একে অপরের উপর নির্ভরশীল । পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ ও সুসজ্জিত শ্রেণিকক্ষের অভাবে নিরানন্দ পরিবেশে অধিকাংশ বিদ্যালয়ে পাঠদান পরিচালনা করা হয়। ফলে শিক্ষার্থীদের