বৃদ্ধাশ্রমে বিষাদেই কাটে তাদের ঈদ

প্রকাশিত: ১০:৫৫ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ১২, ২০২৪

বৃদ্ধাশ্রমে ঈদ এলে যেন বিষাদ নেমে আসে, লোনা জল নেমে আসে দুই চোখ বেয়ে। যদিও ঈদ উপলক্ষে তাদের দেয়া হয়েছে নতুন লুঙ্গি, পাঞ্জাবী, শাড়ি-কাপড়, সেমাই-পোলাও-মাংসসহ নানা খাবার। এরপরও তাদের দু:খ-কষ্ট কাটে না।

কারণ তাদের নাড়িছেঁড়া ধনের জন্য যে কষ্ট, পরিবারের সঙ্গে ঈদের দিন সময় কাটাতে না পারার যে কষ্ট-অভিমান সেটাই সারাদিন তাদের মধ্যে বিরাজ করে। তাই বৃদ্ধাশ্রমে ঈদ উৎসব মানে বিষাদ-কষ্ট, কান্না আর আহাজারির গল্প।

ক’দিন পরপরই ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সড়কে, ডাস্টবিনে কিংবা দীর্ঘ সময় হাসপাতালে পড়ে থাকা অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে নিয়ে আসা হয় গাজীপুর সদরের বিকেবাড়িস্থ গিভেন্সী গ্রুপের মালিকানাধীণ বয়স্ক পূনর্বাসন কেন্দ্রে।

পরিবারের সবাই যখন ঈদ আনন্দে মশগুল। তখন স্বজন, প্রিয়জন ছাড়া গাজীপুরের বৃদ্ধাশ্রমে নিভৃতে চোখের জল ফেলছেন সেখানকার বাসিন্দাদের অনেকেই। ঈদ আসলেই যেন তাদের কষ্ট-দু:খ বাড়ে। দু’চোখ জলে ভরে যায়। পুরানো স্মৃতি হাতড়ে বেড়ায়।

বৃদ্ধাশ্রমে অপরিচিতজনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করলেও চরম অসহায়ত্ব আর একাকীত্ব কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তাদের। তবুও যেন বৃদ্ধাশ্রমই তাদের কাছে শান্তির স্থান। আর বৃদ্ধাশ্রমের মালিক-কর্মকর্তারা যেন অসহায় ওইসকল বাসিন্দাদের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাদের প্রয়োজনীয় সেবা ও চিকিৎসা প্রদান করছেন। এখানে বসবাসরতদের জন্য সর্বোচ্চটা দিয়ে তাদের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করছেন তারা। বিনামূল্যে খাবার, ওষুধসহ পোশাকও দেওয়া হয়। ঈদেও নতুন কাপড় দেওয়া ছাড়াও তাদের জন্য রান্না করা হয় ভালো খাবার।

গাজীপুর সদরের ছায়াঘেরা শীতল সবুজ গাছ তথা প্রাকৃতি সৌন্দর্যে ভরপুর নির্জন বিকে বাড়ি গ্রামের এ বৃদ্ধাশ্রমে বসবাসরত মানুষগুলো কারও বাবা, কারও মা। একসময় সন্তানের সব আশা পূরণ করা ব্যক্তিটি আজ বয়সের ভারে কর্ম অক্ষম হওয়ায় কদর হারিয়েছেন পরিবারের। সন্তান কিংবা ছেলের স্ত্রী কাছে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন প্রতিনিয়ত। তাইতো শেষ বয়সে শেষ আশ্রয় হিসেবেই তারা বেছে নিয়েছেন নির্জন এ বৃদ্ধাশ্রম।

বছর ঘুরে ঈদ এলে প্রিয় সন্তানের স্মৃতি মনে হলেই সিক্ত হয় তাদের নয়ন। তারপরও বুকে চাপা কষ্ট নিয়ে সন্তাদের ভুলতে চেষ্টা করে প্রত্যেকেই ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করেন নিজেদের মতো করেই।

ঈদুল ফিতরের আগের দিন বুধবার গাজীপুর সদর উপজেলার হোতাপাড়ার বিকে বাড়ি গ্রামে বয়ষ্ক পূনর্বাসন কেন্দ্রে (বৃদ্ধাশ্রম) গিয়ে কথা হয় নিজ পরিবার ত্যাগী ও স্বজনদের ছেড়ে আসা কয়েকজন বৃদ্ধা মা ও বাবার সঙ্গে।

বুধবার দুপুরে কথা হয় বৃদ্ধাশ্রমটিতে পাঁচ বছর ধরে থাকা চাঁদপুরের বৃদ্ধা ফিরোজা বেগমের (৬৫) সঙ্গে।

অভিমানের সুরে তিনি বলেন, বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে না। আমি এইহানেই ভালো আছি। এইহানে আশপাশে যারা আছে তাদের লইয়াই আনন্দ। ২০১৮সাল থেকেই এ আশ্রমে আছি, পোলায় তো খোঁজ-খবর লয় নাই। ঈদের দিন দেহাও করতে আসে না। সেই পোলার ঘরে ফিরি কেমনে?

শুধু ফিরোজা বেগমই নন, এরকম আরও শতাধিক বৃদ্ধ বাবা-মায়ের আশ্রয় এখন বিকেবাড়ির বয়স্ক পূনর্বাসন কেন্দ্রে। কিন্তু কারোরই ওই বৃদ্ধাশ্রমে আসার গল্প স্বাভাবিক নয়, হতভাগা সন্তানরা কেউ মাকে ফেলে গেছেন, রাস্তায়, মাজারে, হাসপাতালে। এরপর তাদের ঠাঁই হয়েছে এ বৃদ্ধাশ্রমে।

প্রতিষ্ঠানটির সুপার হাবিবা খন্দকার বেলী জানান, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির আশ্রয়ে রয়েছে ১৫০ বৃদ্ধ মা ও বাবা। এখন পর্যন্ত অজ্ঞাত শতাধিক ব্যক্তির দাফন করেছে এ প্রতিষ্ঠানটি। দীর্ঘদিন ধরেই মানবসেবায় কাজ করে যাচ্ছেন এ বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা খতিব আব্দুল জাহিদ মুকুল। ১৯৮৭ সালে রাজধানীর উত্তরায় এ প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠিত হলেও পরে ১৯৯৫ সালে গাজীপুর সদরের বিশিয়াকুড়ি (বিকে) বাড়ি এলাকায় স্থানান্তর করা হয়। প্রায় ১০০বিঘা জমির উপর গড়ে ওঠা এ কেন্দ্রে ফল বাগান, সবজি বাগান ছাড়াও নিজস্ব জমিতে খনন করা পুকুরে মাছ চাষ, ধান চাষও করা হয়।

প্রতিষ্ঠানটির পুরুষ ভবনের বাসিন্দা ইফতেখার আহমেদ শামীম (৬৯)। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজীতে মাস্টার্স। সিকদার মিলিনিয়াম স্কুলসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টারে চাকুরি করেছেন তিনি। এর আগে তিনি দুবাইয়ে একটি কোম্পানীতে দোভাষীর চাকুরি করতেন। দুই বছর চাকুরির পরে তিনি আবার দেশে চলে আসেন। তার স্ত্রী ছিলেন সৌদিয়ান এয়ারলাইন্সের একজন বিমান বালা। তাদের ঘরে এক ছেলে থাকার পরও পরক্রিয়ায় জড়িয়ে তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়।

পরে ১৯৯১ সালে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে স্বামীকে ত্যাগ করে পৃথক হয়ে যান তার বিমানবালা স্ত্রী। ছেলে এখন বেশ বড় হয়েছে। ঢাকায় তার খালার বাড়ি মাঝে-মধ্যে দেখা করতে আসলেও আমার সঙ্গে তাদের কেউ দেখা করেনা বা আমার কোন খবরও নেয়না। এখন আমার বয়স হয়েছে। আগের মতো কাজকর্ম করতে পারি না। তাই ২০২১ সালের ১৪ মে আমি গাজীপুরের এ বৃদ্ধাশ্রমে চলে আসি। ভালই আছি। তারপরও ছেলেটার জন্য মন কাঁদে। ঈদে একসাথে সেমাই-পোলাও খাবো। কিন্তু সেই কপাল তো আমার নেই। সে কোথায় থাকে কি করে তাও আমি জানিনা। সে যেখানেই থাকুক, ভালো থাকুক। ঈদেও আনন্দ ভালোভাবে কাটুক এ দোয়াই করি।

নিজের মনের কষ্ট উগড়ে দিয়ে ইফতেখার বলেন, এক সময় কতো রোজগার করছি। তখন কি আর ভেবেছি এই বৃদ্ধাশ্রমে জায়গা হবে? ভাবিনি। আজ পরিবার, সন্তান, স্ত্রী কথা মনে হলেও ফেরার সুযোগ নাই। ফিরতে ইচ্ছে করে। সেটা তো আবেগ কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। পরিবারের কর্ম অক্ষম মানুষটি আজ আমি চলতে পারি না। তাই সব আবেগ, কষ্ট চাপা দিয়েই এখানে পড়ে থাকা।

এক ছেলে ও ৫ মেয়েরকে ছোটবেলা থেকেই নিজ হাতে মানুষ করেছেন বাবা মোঃ নুরুজ্জামান। তিনি হাউজ বিল্ডিং ফিন্যান্স করপোরেশনে সহকারি প্রকৌশলী পদে চাকুরি করতেন। তাদের গ্রামের বাড়ি জামালপুরের মদনের চরে। ব্রহ্মপুত্র নদে তাদের বাড়ি-জমি বিলীন হলেও উপজেলায় তিনি হাউজবিল্ডিং থেকে লোন নিয়ে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় ২টি পাকা বাড়ি করেন। একটি বাড়ি মেয়ের জামাই লোন শোধ করে নিজেরাই নিয়ে গেছে। অপরবাড়িটি তার স্ত্রী নিয়ে নিয়েছে কৌশল করে।

অবসরে যাওয়ার পরে ডেভেলপার কোম্পানিতে চাকুরি নেই। এ চাকুরিকালে মাসে যে বেতন পেতাম তার সিংহভাগই স্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দিতাম। কিন্তু স্ত্রী ওই টাকায় নিজের নামে জমি কিনে ও বাড়ি ভাড়ার টাকাও সে আমাকে দেয় না। টাকা চাইলে আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজসহ সকলে মিলে আমাকে দৈহিক-মানসিক নির্যাতনও শুরু করে। শেষে অতিষ্ঠ হয়ে গত বছরের মার্চে এ বৃদ্ধাশ্রমে উঠি। স্ত্রী-সন্তানদের কথা মনে হলেও তাদের অপমান করার কথা মনে পড়লে মনটা বিষিয়ে উঠে। এতোদিন হয়ে গেল কেউ আমার কোন খোঁজও নেয়নি। আমিও নেইনি। আজ আমার সবাই থাকতেও যেন কেউ নেই। একদিন পরেই ঈদ। স্বজনদের রেখে এবারই তার প্রথম ঈদ কাটবে বৃদ্ধাশ্রমে। এ কথা ভেবেই তার দু’চোখ লোনা জলে ছল ছল করে উঠে।

তারপরও স্ত্রী-সন্তানরা ভাল থাকুক এ প্রত্যাশা করেন তিনি। এখানকার বিনামূল্যে পাওয়া সেবা আর প্রয়োজনীয় কাপড়,খাবার, ঔষধ তাকে মানুষিক প্রশান্তিও দিয়েছে। বুকে চাপা কষ্ট নিয়ে এখন ভুলে যেতে চেষ্টা করছেন তার সন্তানদের।

তাদের মতো শতাধিক বৃদ্ধ মা-বাবা এখানে আছে,যাদের অনেকেই পরিবার থেকে বিতাড়িত কিংবা ক্ষোভে পরিবার থেকে এখানে চলে এসেছেন। এখন তো মিডিয়ার আধুনিক যুগ, কোনো বৃদ্ধ মা-বাবার পরিবারের জন্য পোস্ট দিলে বা বিজ্ঞপ্তি হলে অনেকে যোগাযোগ করেন। কিন্তু ঈদের দিনেও দুঃখজনক যে এখানে থাকা কোনো বৃদ্ধ বাবা-মা’কে দেখতে স্বজনদের কোনো পরিবার আসেনা। তখনই তাদের বুক ফাঁটা কান্না আসে।

পরিবারের সবাই যখন ঈদ আনন্দে মশগুল। তখন স্বজন, প্রিয়জন ছাড়া গাজীপুরের বৃদ্ধাশ্রমে নিভৃতে চোখের জল ফেলছেন সেখানকার বাসিন্দাদের অনেকেই। ঈদ আসলেই যেন তাদের কষ্ট-দু:খ বাড়ে। দু’চোখ জলে ভরে যায়। পুরানো স্মৃতি হাতড়ে বেড়ায়।

বৃদ্ধাশ্রমে অপরিচিতজনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করলেও চরম অসহায়ত্ব আর একাকীত্ব কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তাদের। তবুও যেন বৃদ্ধাশ্রমই তাদের কাছে শান্তির স্থান। আর বৃদ্ধাশ্রমের মালিক-কর্মকর্তারা যেন অসহায় ওইসকল বাসিন্দাদের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাদের প্রয়োজনীয় সেবা ও চিকিৎসা প্রদান করছেন।

গাজীপুর সদরের ছায়াঘেরা শীতল সবুজ গাছ তথা প্রাকৃতি সৌন্দর্যে ভরপুর নির্জন বিকে বাড়ি গ্রামের এ বৃদ্ধাশ্রমে বসবাসরত মানুষগুলো কারও বাবা, কারও মা। একসময় সন্তানের সব আশা পূরণ করা ব্যক্তিটি আজ বয়সের ভারে কর্ম অক্ষম হওয়ায় কদর হারিয়েছেন পরিবারে। সন্তান কিংবা ছেলের স্ত্রী কাছে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন প্রতিনিয়ত। তাইতো শেষ বয়সে শেষ আশ্রয় হিসেবেই তারা বেছে নিয়েছেন নির্জন এ বৃদ্ধাশ্রম।

বছর ঘুরে ঈদ এলে প্রিয় সন্তানের স্মৃতি মনে হলেই সিক্ত হয় তাদের নয়ন। তারপরও বুকে চাপা কষ্ট নিয়ে সন্তাদের ভুলতে চেষ্টা করে প্রত্যেকেই ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করেন নিজেদের মতো করেই।

বৃদ্ধাশ্রমের তত্ত্বাবধায়ক বেলী বলেন, অসহায় পরিবারহারা এ মানুষগুলোর সেবা করতে পেরে বেশ আনন্দ পাই আমি। আমি তাদের ভেতর আমার বাবা-মাকে খুঁজে পাই। তাদের সেবা যত্ন করি। এখানে আমি সকাল সন্ধ্যা সবার জন্য কাজ করি। আমার একটুও খারাপ লাগে না। সবাইকে নিয়ে আনন্দে থাকি। এই যে ঈদ আসছে সবাই আমরা একটা পরিবারের মতো। সবাই এক সঙ্গে ঈদ করবো।

বৃদ্ধাশ্রমটি মালিক খতিব আব্দুল জাহিদ মুকুল সাংবাদিকদের জানান, এখানে বসবাসরতদের জন্য সর্বোচ্চটা দিয়ে তাদের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করছেন তারা। বিনামূল্যে খাবার, ঔষধসহ পোশাকও দেওয়া হয়। ঈদেও নতুন কাপড় দেওয়া ছাড়াও তাদের জন্য রান্না করা হয় ভালো খাবার। এখানে তাদের নামাজ আদায়, বিভিন্ন ধর্মের মানুষের জন্য প্রার্থনার স্থান রয়েছে। টিভি, দাবাসহ বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে।

তিনি বলেন, যেসব মানুষের ৬০ বছর বয়স হয়ে গেছে, পরিবার তাদের দেখভাল করতে পারে না। এছাড়া তাদের খেয়াল নেওয়া, যত্ন নেওয়া, চিকিৎসা-স্বাস্থ্য, খাবার ও কথা বলার অবকাশ তারা দিতে পারে না। আসলে তাদের জন্য এ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আর এসব বাবা-মার কথা চিন্তুা করে এ বৃদ্ধাশ্রম বানানো হয়েছে। আমরা এখানে যে অবকাঠামোটি করেছি এখানে আমরা ৮০ জনকে রাখতে পারবো। এখনো আমাদের সমাজে এ মেসেজটি যায়নি, যে প্রবীণ নিবাসেও প্রবীণরা ভালো থাকতে পারে। বর্তমানে এখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মধ্যবিত্ত পরিবারের ৮০ জন বৃদ্ধ এবং ৭০জন বৃদ্ধা বসবাস করছেন।