Md Md

Badsha

প্রকাশিত: ১১:২০ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১১, ২০২৪

জীবন সায়হ্নে সন্মুখ যুদ্ধের নায়ক রহমত আলী মন্টু

এম বাদশা মিয়া ঝিনাইদহ :
রহমত আলী মন্টু এক অকুতোভয় বীরমুক্তিযোদ্ধা। তাঁর পিতা এয়াকুব আলী বিশ্বাস, মা রাবেয়া খাতুন। ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা থানাধীন দামুকদিয়া গ্রামে এই বীর যোদ্ধা ১৯৪১ সালের ২ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগদান করেন। চাকরিকালীন তিনি ১৯৬২ সালে এসএসসি পাশ করেন। ১৯৬৬ সালের ৬ জুলাই তরুণ সৈনিক ছুটি নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নিজ গ্রামে ফেরত আসেন। এ সময় তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং কর্মস্থলে ফিরে না গিয়ে শৈলকুপা থানা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন সাংগঠনিক কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। ২৫ মার্চ পাকবাহিনী রাতের অন্ধকারে নিরস্ত্র বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং গণহত্যা শুরু করে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই নৌসেনা তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। ঝিনাইদহের বিষয়খালি যুদ্ধ ও গাড়াগঞ্জ যুদ্ধে রহমত আলী মন্টু অসীম বীরত্ব ও রণকৌশলের পরিচয় দেন। গাড়াগঞ্জের যুদ্ধে তাঁর পাতা ফাঁদে পাকসেনাদের প্রতিহত করা ছাড়াও কুষ্টিয়া জেলা স্কুলে অবস্থানরত পাকসেনাদের বিরূদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের একটি ইউনিটের তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলে। সকল প্রতিরোধযুদ্ধে তিনি অদম্য সাহসিকতা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ একজন বীর যোদ্ধার পরিচয় দেন। শৈলকুপা প্রতিরোধ যুদ্ধের শুরুতে যোদ্ধাদের তহবিল সংগ্রহে তাঁর প্রশংসনীয় ভূমিকা ছিলো। দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করার সংগ্রামে তিনি ছিলেন একজন বীর কমান্ডার। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি ব্যাঘ্রের মতো গর্জন করে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তেন। কুষ্টিয়া থেকে পলায়নরত ৪০/৫০ জন পাকসেনাকে গাড়াগঞ্জ ব্রিজের কাছে তিনি পর্যুদস্ত করেন। পরে পাকসেনারা সকলেই বিভিন্ন স্থানে ছাত্র, জনতা, ইপিআর, আনসার সদস্যদের হাতে নিহত হয়। লে. আতাউল্লাহ শাহ জীবিত ধরা পড়ে এবং শৈলকুপা হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়। পরে তাকে ৮ নং সেক্টরের প্রথম কমান্ডার মেজর আবু ওসমানের নিকট হস্তান্তর করা হয়। অকুতোভয় এই কমান্ডার শৈলকুপা থানা আক্রমণেও নেতৃত্ব দেন। আলফাপুর যুদ্ধে তিনি অতুলনীয় বীরত্ব ও রণকৌশলের পরিচয় দেন। ঐ যুদ্ধে এক ব্যাটালিয়ন পাকসেনা ও রাজাকার বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় ঘটে এবং ৫০/৬০ জন পাকসেনা ও রাজাকার নিহত হয়। জানা যায়, এ যুদ্ধে কর্নেল শামস নিহত হয়। মর্টারের মুহুর্মুহু শেলের মধ্যে একটি শেল এই বীর যোদ্ধার অবস্থানে বিস্ফোরিত হয় এবং তাঁর মাথার পেছন দিকে একটি স্পিন্টার আঘাত হানে। তিনি গুরুতরভাবে আহত হন এবং চিরজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেন।
শ্রীপুর থানা দখল এবং বালিয়াকান্দি থানা আক্রমণেও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রহমত আলী মন্টু। উল্লিখিত যুদ্ধসমূহে সফল নেতৃত্ব দানের পর এক পর্যায়ে তিনি ভারতের কল্যাণী ক্যাম্পে ৮ নং সেক্টর প্রধান মেজর আবুল মঞ্জুরের সাথে দেখা করেন এবং তাঁর বাহিনীর স্বীকৃতি প্রাপ্তির দাবী জানান। কিন্তু তাঁর অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হলে উভয়ের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। মেজর মঞ্জুর সে কথা মনে রেখেছিলেন। ৮ ডিসেম্বর শৈলকুপা হানাদারমুক্ত হওয়ার সাথে সাথে মেজর মঞ্জুর লে. অলিক গুপ্ত ও সাব-সেক্টর কমান্ডার মোস্তাফিজুর রহমানকে শৈলকুপা পাঠিয়ে দেন এবং তাঁরা শৈলকুপা অঞ্চলের কমান্ডার জনাব রহমত আলী মন্টু, আবু আহমেদ সোনা মোল্যা, ওস্তাদ বিশারত আলী, কাজী আশরাফুল আলম ও গোলাম মোস্তফা এই ৫ জনকে পুরস্কৃত করার কথা বলে মাইক্রোবাসে যশোর সার্কিট হাউসে নিয়ে যান। সেখানে মেজর মঞ্জুর রহমত আলী মন্টুকে চিনতে পারেন এবং জিজ্ঞাসা করেন, ‘আর ইউ রহমত আলী মন্টু? ডু ইউ রিমেম্বার মি এন্ড কল্যাণী? দিস ইজ দ্যা টাইম টু সি ইউ।’ এই বলে ব্যক্তি আক্রোশে উল্লিখিত পাঁচজনকেই তিনি যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রাখার আদেশ দেন। বীরযোদ্ধা হিসেবে যার পুরস্কৃত হওয়ার কথা ছিলো তিনি অন্যান্য বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারসহ কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। এই প্রেক্ষিতে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করে তৎকালীন এমপিএ জনাব খাদেমুল ইসলাম শিশু কাজী বঙ্গবন্ধুর নিকট জরুরি টেলিগ্রাম প্রেরণ করেন এবং বঙ্গবন্ধুর আদেশে তাঁরা সবাই মুক্তি পান।

এই বীর যোদ্ধা রণাঙ্গনের বিজয়ী বীর হলেও জীবন যুদ্ধে তিনি এক পরাজিত সৈনিক। তাঁর স্ত্রী আলেয়া খাতুন। দুই কন্যা মমতাজ নাসরিন ও শাহানাজ পারভীন তিথি বিবাহিতা। চার পুত্রের মধ্যে তানজিলুর রহমান তুহিন মুক ও বধির। ছেলেদের তিনি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারেন নাই। তাঁরা কোনো মতে ভিন্নভাবে স্ত্রী পুত্র নিয়ে বসবাস করেন। বড় ছেলে মাসখানেক আগে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। জীবনের শেষ লগ্নে এই বীর যোদ্ধা পঙ্গু অবস্থায় বৃদ্ধা স্ত্রী ও বধির ছেলেকে নিয়ে শৈলকুপার ওয়াপদাকলোনীর একটি পরিত্যক্ত বাসায় বসবাস করেন। ক্ষয়িষ্ণু জীবনের বোঝা ভিনি আজও বহন করে চলেছেন। কোনো দুঃখ নেই, অভিযোগ নেই। শরীর ভেঙে পড়েছে।কিছুদিন আগেও লাঠি নিয়ে চলতে পারতেন। এখন তাও পারেন না। এ অবস্থায়ও মাঝে মধ্যে সভা-সমিতিতে যান এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করেন।আজিবন নানা প্রকার সমাজ কল্যাণমূলক কর্মসূচির সঙ্গে তিনি নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন। এই বীর মুক্তিযোদ্ধার ঋণ কোনোদিন শোধ করা যাবে না।